ফুচকা, এই শব্দ শুনলেই যেন পঞ্চ ইন্দ্রিয় জেগে ওঠে। এখন ভেবেই পাইনা যে, একটা সময় ছিল যখন ফুচকা একদম পছন্দই করতাম না। সময় বদলেছে, ফুচকা এখন আনন্দ। তা দু-তিন দিন ধরেই ভাবা হচ্ছে সন্ধ্যাবেলা ফুচকা খাবার কথা। কিন্তু হচ্ছে না! গতকাল কলম কিনতে গিয়ে দেখলাম রমরমিয়ে ফুচকা বিক্রি চলছে। তখনই ভেবেনিলাম, নাহ্ আর অপেক্ষা নয়, কাল হবেই। যথা ভাবনা তথা পদক্ষ্যেপ! ব্যাগ ও ঠান্ডা পানিয়ের খালি বোতল নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। বেরানোর সময় মেয়ের সেই আনন্দঘন মুখটা!
ওর কথা ভাবতে ভাবতেই হাঁটছিলাম। বড় রাস্তায় উঠতেই দেখি আসবাবপত্রের দোকানটা খুলেছে। গত কদিন আগের দূর্ঘটনা হয়তো কাটিয়ে উঠছে তাঁরা! হুস্ করে একটা অটো পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল। অন্যান্য দোকানিরাও সন্ধ্যার ধূপধুনো দিয়ে সান্ধ্য ব্যবসা খুলছেন। মৃদু মন্দ হাওয়া চলছে, বেশ লাগছে। তথ্য প্রযুক্তিতে কাজ করার ফলে আজকাল আর সন্ধ্যা দেখা হয়না যে। তাই এই সব সাধারণ রোজকার ব্যাপারগুলোও ভালোলাগছে। যেমন কোনকিছুর অভাব ই তাকে সাধারণত সুন্দর করে তোলে, এও ঠিক তেমন! কিন্তু এই সবই বাঁধ সাধলো সামনের মোড়টা ঘুরতেই। দেখি তিনি অর্থাৎ ফুচকাওয়ালা আসেননি! ওঁর ঐ এক অসুবিধে, রোজ ও কিছুতেই আসেনা! এ এক অদ্ভুত অসহায়তা!! এই কদিনের বাড়ির সকলের অপেক্ষা! ইস্ খুব খারাপ লাগছে। কিছু করারও নেই। ফিরতে ফিরতে ভাবছি যে যাক আজ মুড়িই খেতে হবে। কারণ এখন যে সময় নেই বড় বাজার যাব, অফিস চলছে যে! যাইহোক ফিরে পরিসরের বড় দরজা দিয়ে ঢুকেই পড়েছিলাম প্রায়, তখনই মনে হলো ধুর কিছুই নিয়ে যাবনা? একদিন ভাবলো সবাই যে ফুচকা হবে আজ। যাক একটু সময়ই না লাগবে! ও ম্যানেজ হয়ে যাবে। রিক্সা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। কিন্তু এখন আর ফুচকা নয়, এবার অভিযান তিব্বতী খাবার মোমো। বাড়ি থেকে বেরনোর আগে চুপিচুপি মেয়ে বলছিল, আজ মোমো কি হবে? আমি বললাম কি করে হবে, অফিস আছে যে! তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে। মোমো নিতে গেলে ঢের দেরি হয়। রিক্সা পৌছালো মোমোর দোকানের দোরগোড়ায়। উত্তরবঙ্গের আলিপুরদুয়ারের ছেলে, এখানে সুদৃশ্য একটা টোটো গাড়িকে চলমান দোকান বানিয়ে ব্যবসা করছে। মোমো ছাড়াও আরো কয়েক রকমারি খাবার থাকে। কিন্তু মোমোটা এত ভালো বানায় যে এখন আর খাবার তাকে অন্য কিছু প্রায় নেই। বছর খানেকের দোকান ছেলেটার। মিতভাষী ও ভদ্র ব্যবহার ওর দোকানের জনপ্রিয়তা আরো বাড়িয়ে তুলেছে।
দোকানের সামনে পৌঁছে বললাম মোমো প্যাক করে দিতে, ও মাথা নিচু করে কাজ করতে করতেই হুঁ বলল। বুঝলাম সময় লাগবে। দোকানের সামনে যাওয়ার আগেই একজন গিয়ে তড়িঘড়ি এক প্লেট মোমো অর্ডার দিয়েছিল, যেন আগে না দিলে পাবেনা। এই ভেবে একটু কঠিন দৃষ্টিতেই তাকালাম, পরক্ষনেই মনে হলো এটাওতো হতে পারে যে তার খুব খিদে পেয়েছে। যাইহোক একটু লজ্জাই পেলাম নিজের ভাবনায়। আশেপাশে লোক এসেই যাচ্ছে, আর বলেই যাচ্ছে কে কি নেবে। যদিও প্রায় ৮০ ভাগই মোমো। দোকানি এক এর পর এক মোমোর প্যাকেট বানাচ্ছে, প্লেটে দিচ্ছে আবার নতুন মোমো ভর্তি বাটি বসাচ্ছে উনুনে। কি প্রচন্ড ব্যস্ত ছেলেটি। এর মাঝেই দোকানি ও অন্য গ্রাহকদের মধ্যে খুচরো নিয়ে টানাপোড়েন। ১২০ টাকার জিনিস, কিন্তু টাকা দিচ্ছে ২০০, কেউ ৪০ টাকার খেয়ে ১০০ টাকার নোট দিচ্ছে। যখন আর পারছেনা তখন দোকানি বলছে ইউপিআই করে দাওনা। সব কথাই হচ্ছে মৃদু ভাবে, দোকানি অত্যন্ত যত্ন সহকারে ও ভদ্র ভাবে সব সামলাচ্ছে। তার অদ্ভুত দক্ষতা দেখতে দেখতে বেশ কিছটা সময় বেরিয়ে গেল। আমার ডানদিকে একটি মেয়ে ছিল তা খেয়ালই করিনি। বছর ২৫/২৬ হয়তো হবে। সেও মোমো খেয়ে টাকা দিতে যাবে, কিন্তু ঐ খুচরো নেই। অগত্যা ইউপিআই ভরসা। ইউপিআইএ টাকা দিয়ে ও বেরিয়ে যাচ্ছিল, তখনই আমাদের দোকানি অদ্ভুত সুন্দর ভাবে মেয়েটিকে বলল “ভালো থেকো, এখানে আসলে এসো”। মেয়েটিও একটু মিষ্টি হেসে সম্মতি জানিয়ে বেরিয়ে গেল। ছেলে তার হাতের কাজ থামিয়ে এক মূহুর্ত ঐদিকে দেখতে লাগলো। একটা খুব মিষ্টি যেন তরঙ্গ বয়েগেল ব্যস্ত বাজারের সন্ধ্যেবেলায়।
মূহুর্তটা পেরিয়ে গেলো, আমার দিকে ফিরে দোকানি বললো, ‘উনি মাঝে মধ্যেই আসতেন, কাল ব্যাঙ্গালোর চলে যাবেন। এখানে অনেক দিন কোন কাজের জন্য ছিলেন। বাড়ি এখানে নয়, আর হয়তো দেখাও হবেনা।’ শেষটা করুণ না হলেও একটা হালকা দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেরিয়ে গেল! দোকানির দীর্ঘ নিঃশ্বাসটা শুধুই বাঁধা গ্রাহক চলে যাওয়ার না মনের অন্যকোনো কোন্ থেকে আসা, তা বুঝতে পারলাম না হয়তো। কিন্তু দীর্ঘ নিঃশ্বাসটা সত্যি। দোকানিকে একটু হলেও মনে হলো যেন বিহ্বল। পর মূহুর্তেই অন্য গ্রাহকদের খুচরো নিয়ে চলে আসায় আর কথা এগোলো না। তবু মনটা ভালো হয়ে গেল। মানুষের মনে মানুষ এখনো বাস করে। সব শেষ হয়ে যায়নি।
বাড়ি ফিরে এলাম, মোমো ভর্তি ব্যাগ নিয়ে, মেয়ের সেকি আনন্দ! ঘুরেফিরে এসে এসে খালি বলছে, থ্যাঙ্ক ইউ, আর থ্যাঙ্ক ইউ। আজ মোমোটা একটু বেশিই সুস্বাদু। হয়তো কারণটা, বাড়ির সকলের হাসি সহযোগে মোমো সেবন, আর দোকানির সেই হাসিটা।
Comments